দ্বিতীয় অধ্যায়
ডিম আগে, না মুরগি
আগে ?
আয় অর্জিত হয় সম্পদ থেকে । গাছ যদি সম্পদ হয় তাহলে ফল-ফুল হল আয় । নিয়মিত ফল-ফুল পেতে হলে সম্পদকে যত্ন করতে হয়, রক্ষা করতে হয় । অনেক গাছ থেকে অনেক ফল-ফুল পাওয়া যায় । অর্থাৎ সম্পদ বেশি হলে, আয় বেশি হয়ে থাকে । আজকে গাছের চারা লাগিয়ে যেমন কালকেই ফল-ফুল পাওয়া যায় না, চারা গাছকে বড় হওয়ার জন্য সময় দিতে হয়, তেমনি বিনিয়োগের সাথে সাথেই আয় পাওয়া যায় না । সম্পদ বিনিয়োগের ফলে সৃস্টি হয় । বেশি বিনিয়োগের ফলে বেশি সম্পদ সৃস্টি হয় । তাই বলা যায়, বেশি বিনিয়োগের ফলে বেশি আয় পাওয়া যায় । মোট বিনিয়োগের থেকে মোট সম্পদ বেশি হলে অতিরিক্ত সম্পদ হল বৃদ্ধি বা লাভ । এই অতিরিক্ত লাভ বা বৃদ্ধির সবটাই খরচ না করলে যা পড়ে থাকে, তাই হল সঞ্চয় । আয় বা লাভ বেশি হলে, সঞ্চয় বেশি হতে পারে । সঞ্চয় থেকে আবার বিনিয়োগ হতে পারে । সেই বিনিয়োগ থেকে আবার আয় হতে পারে ।
ডিম আগে, না মুরগি আগে ? এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই । তবে জানি ডিম ফুটে মুরগি হয়, মুরগি বড় হলে ডিম পাড়ে । আয়, সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে প্রায় একই রকম সম্পর্ক আছে । প্রত্যেকে প্রত্যেকের কারণ এবং ফল ।
বিনিয়োগ
বিনিয়োগ বলতে বোঝায়, কিছু অর্থ এমন এক জায়গায় রাখা যেখান থেকে কিছু আয় বা লাভ পাওয়া যাবে । আদর্শ বিনিয়োগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, পূঁজিকে বাঁচানো বা রক্ষা করা । গাছ
বাঁচলে তবে তো ফল পাওয়া যাবে । কিছু টাকা কোন একটা জায়গায় বিনিয়োগ করা হল, আর
তারপর কুম্ভকর্ণের মত নিদ্রা দেওয়া হল, সেটা বিনিয়োগের পন্থা নয় । আপনার বিনিয়োগ
ঠিকমত আছে কিনা, মাঝে মাঝে তার খোঁজ-খবর রাখতে হবে । হতে পারে, আপনি কোন তথ্যের
দ্বারা, বা কারো পরামর্শের দ্বারা ভুল পথে পরিচালিত হলেন । চারিদিকে সবাই হা করে
বসে আছে । সতর্ক না হলেই বিপদ । একটা উদাহরণ দিই-
আমাকে রোজ ট্রেন থেকে নেমে প্রায় একঘণ্টা বাস চাপতে হয় অফিসে যাবার জন্য । এই
একঘণ্টার যাত্রাপথে একদিন এক ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের সাথে দেখা । বাসে তিনি ঠিক
আমার আগের সিটে বসেছেন । তার পাশে বসেছেন এক স্কুল শিক্ষক । শিক্ষক মহাশয়ের চাকরি
আর বেশী দিন নেই । সামনেই তার সুপার অ্যানুয়েশন, মানে রিটায়ারমেন্ট । একথা ওকথা
বলতে বলতে তিনি ম্যানেজার মশাইকে বলে ফেললেন তার মনের কথাটা । রিটায়ারমেন্টের পরে
অনেকগুলো টাকা পাব, কি করা যায় সেটা দিয়ে ? ম্যানেজার তার ব্যাগের মধ্যে সব সময়
লজেন্স রাখেন । একটা বের করে দিলেন মাস্টারমশাইকে । খানিকপরে বললেন, ‘একটা ভাল
আইডিয়া আছে আপনার জন্য । এতে আপনি অনেক লাভবান
হবেন’ । আমি মূর্খ মানুষ,
বড় বড় মানুষের সান্নিধ্য খুব একটা পাই না । আসলে ঠিকমত গুছিয়ে কথা বলতে পারি না ।
যত ভাবি, ভাল করে গুছিয়ে কথা বলব, তত কথা গুলিয়ে যায় । তাই বড় মানুষদের সাথে কথা বলা আমার আর হয়ে ওঠে না । জানতেও
পারি না অনেক কিছু । কথাটা কানে আসতেই আমি কান খাড়া করে রাখলাম । ম্যানেজার বললেন,
‘আপনি ধরুন, দশ লাখ টাকা পাবেন । সেটা আমার ব্যাংকে সেভিংস অ্যাকাউন্টে রাখলেন ।
আমি আপনাকে একটা রেকারিং ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট খুলে দেব । প্রতি মাসে সেখান থেকে,
ধরুন, দশ হাজার টাকা, ওই রেকারিং অ্যাকাউন্টে চলে যাবে । বর্তমানে সেভিংস অ্যাকাউন্টে
কত সুদ দেয় ? ধরুন পাঁচ পারসেন্ট, আর রেকারিং যদি দুই বছরের বেশী হয়, তাহলে আট
পারসেন্ট । তাহলে কি হবে, আপনি পাঁচ পারসেন্টও পেলেন, আট পারসেন্টও পেলেন । মোট কত
হল? তের পারসেন্ট । কেউ দেবে আপনাকে ? আমি আপনাকে ঠিক ব্যবস্থা করে দেব’ । কথা বলা
শেষ হলে শিক্ষক মশাইকে আরও একটা লজেন্স দিলেন । মাস্টার মশাই তো খুব খুশী ।
কথাটা শুনে আমি চুপ থাকতে পারলাম না । ম্যানেজারকে বললাম, আপনার হিসাবটা ঠিক
হল না । আপনি ওনাকে ভুল বোঝাচ্ছেন ?
ম্যানেজার তাকালেন আমার দিকে । মাস্টার মশাই বললেন, সঞ্জয় বাবু কমার্সের লোক,
দিনরাত শেয়ার বাজার করেন । ওনার কাজ শুধু হিসাব আর হিসাব, টাকা আর পয়সা । বলেন,
সঞ্জয়বাবু ?
আমি বললাম, ‘সেভিংস আর রেকারিং, দুটো ডিপোজিটের মধ্যে বেশী সুদ রেকারিং-এ।
আপনার মোট টাকা দুই ভাগ করে দু’জায়গায় রাখছেন । সব টাকা রেকারিং-এ রাখলে, আপনি যে
আট পারসেন্ট পেতেন, দুই জায়গায় ভাগ করে রাখলে আপনি তাও পাবেন না । মানে, যেখানে
আট-ই পাবেন না, সেখানে তেরো-র কোন গল্প নেই’ ।
ম্যানেজার বললেন, ‘কেন পাবেন না, আমাকে বোঝান ?’
আমি বললাম, ‘আপনাকে আমি বোঝাতে পারব, কিন্তু এখানে নয় । ফাঁকা জায়গায় গিয়ে ।
উনি হেসে বললেন, ‘আপনাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে । আপনারা দেশের
ভবিষ্যৎ তৈরি করছেন । এই নিন, লজেন্স খান’ ।
এইরকম পরামর্শদাতা পেয়ে গেলে আপনার বিনিয়োগ কোথায় হবে বা কোথায় চলে যাবে, সেটি
ভাববার বিষয় । কিছুতেই আপনি কাগজপত্রের রিটার্ন(Returns)-এর সাথে প্রকৃত রিটার্ন মেলাতে পারবেন না । হিসাব মেলাতে গিয়ে দেখবেন, প্রকৃত
রিটার্ন সব সময় কম হচ্ছে । তখন গালাগালি দেবেন । প্রথমে সঞ্জয় বাবুকে গালাগালি দিলেন
ব্যাঙ্ক-ম্যানেজারের কথা শুনে । পরে ব্যাঙ্ক-ম্যানেজারকে গালাগালি দেবেন রিটার্ন
কম হল বলে ।
বিনিয়োগ বিভিন্ন ভাবে করা যেতে পারে- ব্যাংকে নানা প্রকল্পে জমা রেখে, শেয়ার, বন্ড বা মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট কিনে রেখে, জমি-বাড়ি কিনে, সরাসরি কাউকে ধার দিয়ে ইত্যাদি ভাবে বিনিয়োগ হতে পারে ।
বিনিয়োগের দুটি দিক আছে - ঝুঁকি যুক্ত বিনিয়োগ, ঝুঁকিহীন বিনিয়োগ ।
ঝুঁকিহীন বিনিয়োগ হল কষ্টার্জিত অর্থ ব্যাংকে বা পোস্ট-অফিসে ফিক্সড ডিপোজিট, রেকারিং ডিপোজিট, মাসিক আয় প্রকল্প ইত্যাদিতে রাখা যা নির্দিষ্ট সময় অন্তে পূর্বনির্ধারিত হারে আপনার আসলের সাথে ফেরত পাওয়া যায় । আর ঝুঁকিযুক্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ফেরতের নির্দিষ্ট কোন হার নেই, সময়ও নেই
। কখনও কখনও আসলের অনেকগুন বেশি ফেরত পেতে পারেন , বা আপনার আসলের অনেকটা নাও পেতে পারেন । যেমন- শেয়ারে বা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ । এখানে ঝুঁকি একটু বেশি, তাই কপাল মন্দ না হলে, ফেরত লাভও অনেক বেশি ।
বিনিয়োগ ও বাজী ধরার মধ্যে মূল পার্থক্য হল, বিনিয়োগকে আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, প্রয়োজনে খানিকটা হ্রাস বৃদ্ধি করতেও পারেন, কিন্তু বাজী ধরাকে আপনি কোনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না । বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত আপনার ভুল হলে, আপনি অল্প সময়ের মধ্যে অল্প ক্ষতির বিনিময়ে সেটা তুলে নিতে পারেন, কিন্তু বাজী ধরা বা লটারির ক্ষেত্রে তেমন কোন সুবিধা নেই । লটারির টিকিট কেনা, বাজী ধরা ঝুঁকিপূর্ণ খেলা । এখানে টাকা রাখা হয় একটি অনিশ্চিত ধারণায় যে আপনি ঠিক হবেন । যদি ঠিক হন, তাহলে সব কিছু আপনার, আর ভুল হলে আপনার সব কিছু গেল । এলোপাথাড়ি ভাবে বাজী ধরার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কিন্তু বিনিয়োগের আগে অনেক হিসাব-নিকাশ করে তার পর তার সময়, পরিমাণ ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয় । বাজী ধরা বা লটারির টিকিট কাটা এক ধরণের খামখেয়ালিপনা, কিন্তু একজন প্রকৃত বিনিয়োগকারী কোন প্রকার খামখেয়ালিপনায় ভর করে বিনিয়োগ করেন না । সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল, বিনিয়োগ হয়ে গেলেও নানা প্রকার গাণিতিক, সংখ্যাগত বা অন্য কোন উপায়ে তা বিচার-বিশ্লেষণ করে তার ভুল গতিপ্রকৃতি সংশোধন করা যায়, কিন্তু বাজী ধরার পর তার গতিপ্রকৃতি চালচলনে আপনার হস্তক্ষেপের কোন অবকাশ নেই । প্রকৃত বিনিয়োগের ফলে সবাই উপকৃত হয়, বাজী ধরার ফলে কেবলমাত্র এক পক্ষ উপকৃত হয়।
তাহলে প্রশ্ন অনিবার্য ভাবে আসে, বিনিয়োগেও ঝুঁকি থাকে, তাহলে বিনিয়োগ করব কেন ? ঝুঁকিহীন বিনিয়োগও আছে, সেখানে রিটার্ন কম; রিটার্ন বেশি যেখানে, সেখানে ঝুঁকি একটু বেশি । স্রোতে সাঁতার কাটা অনেক সহজ, যারা সাঁতার জানেন, তাদের ডুবে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, আগে থেকে শিখে রাখা সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটা একটা দারুণ কাজ, একটা আর্ট ।
বাজারে চাহিদা ও যোগানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় জিনিসের দাম নির্ধারিত হয় । যখন
চাহিদা বেশী থাকে কিন্তু যোগান কম থাকে, তখন জিনিসের দাম বাড়ে । আর যখন যোগান বেশী চাহিদা কম, তখন দাম কমে । দাম বাড়তে থাকলে বেশী দামে জিনিস বিক্রি করা যায়, ফলে লাভ বেশী পাওয়া যায়, তাই যোগান বেড়ে যায়, ফলে দাম আবার কমতে শুরু করে । আবার দাম কমতে কমতে অনেক নিচে নেমে গেলে, কম দামে জিনিস পাওয়া যাচ্ছে মনে করে ক্রেতারা জিনিস কিনতে শুরু করে, ফলে চাহিদা আবার বেড়ে যায়, দাম বাড়তে শুরু করে । এটা হল আসল কথা । বাকি সব ফাটকা(Speculation) ।
তবে এইরকম অনেক কারণ আছে,
কোন শেয়ারের দাম বাড়া বা কমার ক্ষেত্রে । কোম্পানির ব্যবসা যদি ভাল চলে, যদি
কোম্পানি মুনাফার পরিমাণ লাগাতার বাড়াতে পারে, তবে কোম্পানির ভ্যালুয়েশন বাড়বে ।
কোম্পানি সম্পর্কে মানুষের আস্থা বাড়বে । তাহলে তার শেয়ারের দাম বাড়বে ।
এইক্ষেত্রে কোম্পানির শেয়ারের দাম রাতারাতি বাড়ে না, ধীরে ধীরে বাড়ে । যে
কোম্পানির শেয়ারের দাম ধীরে ধীরে বাড়ে, তার ভবিষ্যৎ ভাল, সে লম্বা দৌড়ের ঘোড়া । এই
শেয়ারগুলোই আসলে বিনিয়োগের উপযুক্ত ।